ইসলামে বাদ্যযন্ত্র ও মিউজিক ব্যবহারের ব্যাপারে শরঈ বিধানঃ
আমরা দেখতেপাচ্ছি বর্তমানে, কিছু মুসলমান দিন দিন মিউজিককে ইসলামিক করার চেষ্টা করছে। কতক আলেমও এদিকে ধাবিত হচ্ছেন। ফলে সাধারণ মানুষ এটাকে হালাল বানিয়ে নিচ্ছে। এটা কিয়ামতের একটা আলামত। যা হারাম তাতে দুনিয়ার সবাই হাবুডুবু খেলেও তা হারামই থাকবে। কোনো আলেমের ভ্রষ্টতায় শরিয়ত উল্টে যাবে না।
হাদিসে নববীতে বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে এবং এটাকে হারাম ঘোষণা করেছে।
রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ليكونن من أمتي أقوام يستحلون الحر والحرير والخمر والمعازف "আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু গ্রুপ সৃষ্টি হবে যারা ব্যভিচার, রেশমি কাপড়, মাদকদ্রব্য ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে
(সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর 5590)
রাসুলুল্লাহ বলেছেন, "সমাজে যখন গায়িকা, বাদ্যযন্ত্র ও মাদকদ্রব্য সেবন ব্যাপকতা লাভ করবে তখন এই উম্মতের জন্য ভূমিধ্বস, চেহারা বিকৃতি এবং পাথর বর্ষণের শাস্তি রয়েছে।"
الألباني (١٤٢٠ هـ)، صحيح الترغيب ٢٣٧٩ • حسن لغيره
একটি দুর্বল হাদিসে এসেছে,
وأمَرَني ربِّي بمَحقِ المَعازفِ
"আমার রব আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আমি যেন গান-বাজনার যন্ত্রপাতি নিশ্চিহ্ন করে দেই।"
أن ابنَ عمرَ سمِع صوتَ زمارةِ راعٍ فوضَع إصبعَيه في أذنَيه وعدل راحلتَه عن الطريقِ وهو يقولُ: يا نافعُ أتسمعُ؟ فأقولُ: نعم فيمضي حتى قلت: لا، فوضع يدَيه وأعاد راحلتَه إلى الطريقِ وقال: رأيت رسولَ اللهِ ﷺ وسمع صوتَ زمارةِ راعٍ فصنع مثل هذا
أحمد شاكر (١٣٧٧ هـ)، مسند أحمد ٦/٢٤٦ • إسناده صحيح
"হজরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার রাখালের বাঁশির আওয়াজ শুনে তার কানের ভিতরে দুটো আঙ্গুল রাখলেন এবং তার বাহন পথ থেকে ফিরিয়ে নিলেন। তারপর তিনি (তাঁর ছাত্রকে) বললেন, হে নাফে' তুমি কি এখনো সেই আওয়াজ শুনছ? বললাম হাঁ শুনতে পাচ্ছি, তারপর তিনি আগের মতো করেই চলতে লাগলেন, যতক্ষণ আমি বললাম না এখন আর শুনতে পাচ্ছি না। যখন এটা বললাম তখন তিনি তার দু'হাত কান থেকে বের করে রেখে দিলেন এবং তার বাহন পথে ফিরিয়ে আনলেন এবং বললেন: রাখালের বাঁশির আওয়াজ শুনে রাসুলুল্লাহকে আমি এরুপ করতে দেখেছি।
#ইমামদের মতামত:
আহকামুল কুরআনে হানাফি মাজহাবের ফতওয়া উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিনোদনের শব্দ যেমন বাঁশের বাঁশি ইত্যাদি শোনা হারাম।
(আহকামুল কুরআন, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২২৯.)
ইমাম মালিক সম্পর্কে বলা হয়েছে,
كان مالك يكره الدفاف والمعازف كلها في العرس
"তিনি বিয়ের অনুষ্ঠানেও দফ এবং বাদ্যযন্ত্র বাজানো অপছন্দ করতেন।"
(আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা, পৃষ্ঠা ৩৯৭)
ইমাম ইবনে কুদামা আল মুগনি গ্রন্থে হাম্বলি মাজহাবের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, "বিনোদন দুই প্রকার: এক প্রকার হারাম। তার মধ্যে গায়িকার বাদ্যযন্ত্র অন্যতম। যেমন বাঁশি, ঢোল ইত্যাদি। দ্বিতীয় প্রকার মুবাহ। যেমন, বিয়ের অনুষ্ঠানের দফ বাজানো।
(আল মুগনি খন্ড-৬ পৃষ্ঠা, ৩৬)
মুফতি মুহাম্মদ শফি রহ. শাফেয়ি মাজহাবের ফতওয়া উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, "গানের অনুসঙ্গ হিসেবে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করাও হারাম।"
(আহকামুল কুরআন, ৩য় খণ্ড, পৃ. 238)
#ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন,
والمعازف هي خمر النفوس... فإذا سكروا بالأصوات حل فيهم الشرك.
"গান বাজনা হচ্ছে আত্মার মদ । যখন তারা সুরের নেশায় মত্ত হয়ে যায় তখন তাদের জন্য শির্কের দরজাও উন্মুক্ত হয়ে যায়"।
(মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড, 15; পৃ. 313)
শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহ. বলেন, "বিনোদন দুই প্রকার। একটি হারাম, যেমন বাঁশি বা অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান। অন্যটি মুবাহ। যেমন, ওয়ালিমা বা এই রকম আনন্দ প্রকাশের অনুষ্ঠানে দফ বাজিয়ে গান।"
(হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, 2/192)
#সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদুদী রহ. বলেন, "হাদিসে এসেছে, নবী সা. বলেছেন, "আমি বাদ্যযন্ত্র ভাঙ্গার জন্য প্রেরিত হয়েছি।"
এখন বলুন যে নবী এই কাজের জন্য প্রেরিত হয়েছেন তার অনুসারীরা আবার এসব বাদ্যযন্ত্র তৈরি এবং এগুলোর ব্যবসা ও ব্যবহারে নিজেদের শক্তি সামর্থ্য নিয়োজিত করবে, একথা কেমন করে ঠিক হতে পারে?
সে যুগে দফ ছাড়া আর কোনো বাদ্যযন্ত্র ছিল না, এটা ভুল কথা। তৎকালীন পারস্য, রোম এবং আরবের সভ্যতা সংস্কৃতির ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ব্যক্তিই এমনটি বলতে পারে। বিভিন্ন প্রকার বাজনার নাম তো জাহেলি যুগের কাব্যেও পাওয়া যায়। নবী সা. বিয়ে-শাদী ও ঈদ উপলক্ষ্যে দফ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন, এটিই চূড়ান্ত সীমা। এর বাহিরে কোনো ব্যক্তির জন্য এটা ব্যবহার করা বৈধ নয়। এই চূড়ান্ত সীমাকে যে ব্যক্তি সূচনা বিন্দু বানাতে চায়, খামোখা এমন নবীর অনুসারীদের মধ্যে তার নাম লেখাতে কে তাকে বাধ্য করেছে, যিনি বাদ্যযন্ত্রে ভাঙ্গার জন্য প্রেরিত হয়েছেন। (রাসায়েল ও মাসায়েল খন্ড 1, পৃষ্ঠা 150-151।)
#এইভাবে অসংখ্য আলেমদের মতামত দেওয়া যেতে পারে। এক কথায় প্রায় সমস্ত আলেমগণ একবাক্যে বাদ্যযন্ত্র হারাম ফতওয়া দিয়েছেন। যারা বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করেন তারা ইমাম ইবনে হাযমকে দলিল হিসেবে ব্যবহার করেন। কেননা তিনি বাদ্যযন্ত্রকে বৈধ মনে করতেন। এখন তাঁর মতামতের ওপর একটু পর্যালোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
#ইমাম ইবনে হাযম জাহেরি মাজহাবের একজন প্রসিদ্ধ ফকিহ ও মুহাদ্দিস ছিলেন। তাঁর একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে আল মুহাল্লা। উক্ত গ্রন্থে তিনি চার মাজহাবের অনুকূলে অনেক ফতওয়া দিয়েছেন। আবার বেশ কিছু ফতওয়া চার মাজহাবের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত প্রদান করেছেন। যেমন, চার মাজহাবের ইমামদের ঐক্যমতে ব্যভিচারের সাক্ষ্য চারজন পুরুষ হতে হবে, এ ক্ষেত্রে মহিলার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। আর ইবনে হাযমের মত হচ্ছে একজন পুরুষের পরিবর্তে দুইজন মহিলা হলেও চলবে। এমনকি চারজন পুরুষের পরিবর্তে আটজন মহিলা হলেও অসুবিধা নেই।
তিনি বিয়ের ক্ষেত্রে কনে দেখার ব্যাপারে এমন অবস্থান নিয়েছেন যা কোনো যুগে কোনো আলেম গ্রহণ করেননি। তিনি বলেন, يباح له النظر إلى بدها ما ظهر منه و ما بطن إلا الفرج والدبر "বিয়ের উদ্দেশ্যে (কনে দেখতে গেলে) কনের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবকিছুই সে দেখতে পারে কেবল লজ্জাস্থান ও নিতম্ব ছাড়া ।" (আল মুহাল্লা, 10/30-31)। অথচ আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের সর্বসম্মতভাবে ফতওয়া হচ্ছে কেবল মুখমণ্ডল ও হাত-পা দেখতে পারে।
চার ইমামসহ অধিকাংশ আলেমদের মতে মহিলাদের মসজিদে যাওয়া জায়েজ তবে ঘরে পড়া উত্তম। আর ইমাম ইবনে হাযমের মতে মহিলাদের জন্য মসজিদে যাওয়া উত্তম। (আল মুহাল্লা)
এই রকম অনেক জায়গায় তাঁর পদস্খলন ঘটেছে। এইভাবে একাধিক জায়গায় যেহেতু তাঁর পদস্খলন ঘটেছে, সেহেতু গান বাজনার ক্ষেত্রেও পদস্খলন ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। গান-বাজনা বৈধ হওয়ার সম্পর্কে মতামত দিতে গিয়ে তিনি বলেন,
إنه لا يصح في الباب حديث أبداً وكل ما فيه موضوع
"গান বাজনা সংক্রান্ত অধ্যায়ের কোনো হাদিস সহিহ নেই বরং তার প্রত্যেকটি হাদিসই জাল ও বাতিল।
(ইমাম শাওকানী, নাইলুল আওতার, খণ্ড 8, পৃষ্ঠা 179)
আমরা উপরে বুখারি শরিফের যে হাদিসটি উল্লেখ করেছি, সেটিকে তিনি মুনকাতি বা বিচ্ছিন্ন বলেছেন। (প্রাগুক্ত)। অথচ এই হাদিস সম্পর্কে ইবনে হাজার আসকালানি বলেন,
والحديث صحيح معروف الاتصال على شرط الصحيح
"হাদিসটি সহিহ, প্রসিদ্ধ এবং সহিহ আল-বুখারির শর্ত অনুযায়ী সনদও অবিচ্ছিন্ন। (ফাতহুল বারী)
শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী বলেন হাদিসটি সহিহ এবং মুত্তাসিল অর্থাৎ সনদ অবিচ্ছিন্ন। (আল ইনসাফ ফি বায়ানে আসবাবিল ইখতিলাফ, 61)
আর আলেমদের ঐক্যমতে বুখারি শরিফে কোনো দুর্বল বা জাল হাদিস নেই। অতএব, এখানেও তাঁর যুক্তি ও মতামত অগ্রহণযোগ্য। তাই আমরা মনে করি অন্যান্য বিষয়ের মতো এখানেও তাঁর জল্লাত বা পদস্খলন ঘটেছে।
আর সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের সমস্ত আলেমের বিপরীতে দু'একজন আলেমের ব্যক্তিগত মতামত কীভাবে দলিল হতে পারে? তাহলে এখান থেকে কি এটাই প্রতীয়মান হয় না যে, আমরা জেনে শুনেই নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তাঁদেরকে ব্যবহার করছি? তাদের ভুল হলেও নিয়ত সহিহ থাকার কারণে আল্লাহর কাছ থেকে তারা পার পেয়ে যাবেন হয়তো। কিন্তু আমরা যারা হারাম জানা সত্ত্বেও নিজের সুবিধার্থে তাদের মতামত গুলোকে পুঁজি করে গান-বাজনায় মত্ত হয়ে আছি, আমরা আল্লাহর কাছে কী জবাব দেব?
লেখক- শায়খ আসলাম হোসাইন,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া থেকে আল-হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।