অনির্বাচিত সরকার আতংকঃ এডভোকেট সাজজাদুল ইসলাম রিপন

অনির্বাচিত সরকার আতংক!

সরকার একটা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের নিদর্শন। মানে একটা রাষ্ট্র পরিপূর্ণতা পেতে নির্দিষ্ট ভূখন্ডের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট সরকার থাকা বান্ঞনীয় (মন্টিভিডিও কনভেনশন)।  তাই প্রতিটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সরকার থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এ সরকার গঠনের ফর্মূলা একটা দেশের সংবিধানে সাধারণত বলা থাকে। সরকারের মেয়াদ বা সময়কালও দেয়া থাকে সংবিধানে। গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের মেয়াদান্তে নির্বাচনই একমাত্র নতুন সরকার পাবার মাধ্যম। অন্য কোনো উপায়ে নয়। তাই গনতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন আসলে জনগন একটু নড়েচড়ে বসে। কারন এ সময়টা তাদের মনের কথা / মেনডেট বলার উত্তম সময়। আবার সরকারে থাকা সরকারি দলের জবাবদিহিতারও এটা মোক্ষম সময় বলে বিবেচিত। 

অপরদিকে অনির্বাচিত সরকার হলো যারা জনগনের ভোটে নির্বাচিত নয়, এমন সরকারকে বুঝায়। গনতান্ত্রিক দেশে সাধারণত এর অস্তিত্ব নেই। কারন এমন দেশে জনগন সকল ক্ষমতার উৎস বলে বিবেচিত। আমাদের দেশেও তাই। (অনুচ্ছেদ ৭, সংবিধান)। কিন্তু বাস্তবতা হলো এদেশে এরশাদ সরকারের পতন পরবর্তীতে কয়েকটা নির্বাচন কালীন সরকারই ছিল অনির্বাচিত সরকার। তাই আমাদের মত গনতান্ত্রিক দেশে ইতোমধ্যে এই অনির্বাচিত সরকারের অস্তিত্ব বিদ্যমান। এটা মূলত অস্তিত্বে এসেছে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থাহীনতা ও স্বচ্ছতার অনুপস্থিতির কারণে যা দেশের সাধারণ জনগনের কাছেও অনেকটা যৌক্তিক বলে ইতোমধ্যে বিবেচিত হয়েছে। 

সংবিধান একটি মানুষের তৈরি আইন। এ আইনের সংশোধন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন,পরিমার্জন সম্ভব। দেশ ও  জনগনের স্বার্থে এ দেশের ক্রান্তিকালে এ সংবিধান সংশোধন হয়েছে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তৎকালীন বিরোধীদলের আন্দোলন ও জনগনের দাবির মুখে তদানীন্তন সরকার বাধ্য হয়েছিল সংবিধান সংশোধন করে অনির্বাচিত ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে। কারণ নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন স্বাধীন, স্বচ্ছ হবার বিষয়ে অধিকতর সন্দেহ রয়ে যায় এবং নির্বাচন নিজেদের অনুকূলে নিতে সমস্ত রাষ্ট্রীয় সেটআপ দিতে দারুণ সুযোগ অবারিত থাকে। এমনি মুহুর্তে সে সময়ের সরকার জনগনের দাবির কাছে মাথানত করে ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে রইলেন আজও। কারণ জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস।

২০০৭/২০০৮ সালের নির্বাচন পূর্বে এ অনির্বাচিত সরকার প্রক্রিয়া নিয়ে সে সময়ের সরকারের কারসাজি পরবর্তীতে নতুন কেয়ারটেকার সরকার / অনির্বাচিত সরকার নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত সময়কাল ক্ষমতায় থেকে ও সরকারি ও বিরোধীদলের নেতা, নেত্রীদের আইনি হয়রানিতে, সেসময়ে এ অনির্বাচিত সরকারের উপর জনগনের বিরক্তির কারন হয়েছিল। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে সরকার গঠন করে এ অনির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে, নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করার নতুন ফর্মূলার আবর্তন করে। তখন থেকে পরপর দু'বার নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কেবলমাত্র সংবিধানের দোহাইয়ে এমন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এ নির্বাচন নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন দেশে ও আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে। 

কারণ গনতন্ত্রের দেশে জনগনের ভোটাধিকার কতটুকু ঠাঁই পেলো সে নির্বাচনগুলোতে তা দেশ ও দশের কাছে পানির মত পরিষ্কার। ফলশ্রুতিতে দেশে জাতীয় নির্বাচন আসলে দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। অপরদিকে তখন দেশের সাধারণ মানুষ পড়ে বিপাকে। ইতোমধ্যে সরকার ও বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীর মুখে অনির্বাচিত সরকারের বিষয়ে শুনা যাচ্ছে নানান কথা, গুঞ্জন ও জল্পনা-কল্পনা। কারণ এ দেশের বিরোধী দল সরকারি দলের উপর আস্থা রাখতে পারেনা, যেমনি আস্থা রাখতে পারেনি ১৯৯৬ সালে। স্বাধীন, গ্রহনযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এ দেশের সকল সাধারণ জনগন চায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এমন স্বচ্ছ নির্বাচনের চাপ রয়েছে। তাই নির্বাচন কালীন সরকার ব্যবস্থা এ দেশের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ন বলে বিবেচিত। 

কারণ একমাত্র নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা পক্ষপাতহীন একটা নির্বাচন সুযোগ করে দিতে পারে। তাই সরকার ও বিরোদী দলগুলো সমঝোতায় এ নির্বাচনকালীন সরকার নির্ধারন হতে পারে। নচেৎ কথিত অনির্বাচিত সরকার এসে এমন করে জুড়ে বসতে পারে যার খেসারত রাজনৈতিক দলগুলোকে গুনতে হবে অতীতের মত। অপরদিকে এমন পরিস্থিতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যেকোনো রাজনৈতিক  কর্মসূচি ভোগান্তি নিয়ে আসবে দেশ ও জনগনের উপর। বর্তমানে একটা গনভোট দিলেও এটা প্রমানিত হবে যে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার এ দেশে দরকার যেখানে জনগন স্বাধীনভাবে নিজের ভোট নিজে দিতে পারবে। এমন বোধগম্যতা যত আগে সকল মহলের হবে, ততই মঙ্গল হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ও দেশের জনগণের। কারণ কেবল ক্ষমতায় থাকায় রাজনীতি নয়, জনগনের  ভালোবাসায় থাকায় হলো প্রকৃত রাজনীতি।

লেখক- সাজজাদুল ইসলাম রিপন

এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি (বি.আই.ইউ) এ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম