সফলতা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। তবে মানুষ জন্ম থেকেই সফল হাওয়ার স্বপ্ন লালন করে তার অন্তরে। প্রতিটি সফল প্রান দেশ ও দশের সম্পদ। একজন সফল ব্যাক্তি অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। তার গল্পগুলো মানুষের চলার পথের পাথেয়। কিন্তু সফল মানুষের গল্পগুলো সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। আগেরকার সময়ের সফলতার গল্প আর আধুনিক সময়ের সফলতার গল্পের মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক। এর কারনগুলো হয়তো সমাজ ও পারিপার্শ্বিক বস্তুগত পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত। মানুষ সামাজিক জীব বলে এ সমাজের ধরণ ও প্রকৃতি মানুষকে সহজে প্রভাবিত করে।
এক সময়ে সফল মানুষের তালিকায় দেখানো হতো মানুষ কতটা দেশ ও দশের তরে নিজেকে বিলীন করেছে তার মানদণ্ডে। সত্যের পথে থাকতে গিয়ে কতবার নির্যাতন ও নিপিড়নে শিকার হয়েছে, একটা সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মানে নিজেকে কতবেশি সম্পৃক্ত করেছে, মানুষের জীবনে ও কল্যানে কত বেশি নিজেকে মোতায়েন করেছে, ইত্যাদি। এ কাজগুলো করতে গিয়ে কখনো কোনো সম্মাননা পাবার আশায় থাকতো না সে সময়ের মানুষেরা। একবার ইত্যাদি প্রোগ্রামে দেখেছি একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে বাড়ী, বাড়ী গিয়ে বই বিতরণ করে তা আবার পড়া শেষে লাইব্রেরিতে ফেরত দিয়েছে। এর কোনো বিনিময় নেয়নি। উদ্দেশ্যে ছিলো মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা ও সেচ্ছাসেবী হিসাবে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়া।
সফলতার আরো গল্পে ছিল কিভাবে বিড়ি বিক্রেতা আকিজ সাহেব নিজ পরিশ্রম গুনে একজন বড়ো উদ্যোক্তা হলেন। কিভাবে নিজের প্রতিষ্ঠান গুলোতে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলেন। আরো ছিলো উদ্যোক্তা জহিরুল ইসলাম কিভাবে ছোট ও স্বল্প থেকে মস্ত বড়ো শিল্প উদ্যোক্তা হলেন। তখনকার সময়ে সফলতার গল্পে আরো যুক্ত হতো মানুষের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নব নব আবিষ্কারের গল্প গুলো। তাছাড়া বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেয়া ডাক্তারদের নামও দেখা যেতো এ কাতারে, যারা অর্থ উপার্জনের চেয়ে মানুষের সেবাকে মহান দায়িত্ব বলে ভাবতো। এমন মানুষগুলোই তখন ছিলো সফল মানুষের তালিকায়। আর অন্যরা অনুপ্রেরণা পেত এমন মানুষের গল্পে, সান্নিধ্যে।
এ গল্পগুলো এখন আর আগের মত মানুষ দেখতে পায় না। কারন ইতোমধ্যে সফলতার সংগা পরিবর্তন হয়েছে ঢের। আগে যেসব বিষয় বিবেচনায় সফলতার গল্প বলা হতো, এখন ওই গল্পগুলো পরিবর্তন হয়েছে। এখনকার গল্পগুলো অনেকটা উল্টো। কার চেয়ে কে বেশি টাকা আয় করলো, কে কত বেশি আয়কর দিলো, কার কত বেশি ব্যাংক ব্যালেন্স রয়েছে, এগুলো হয়েছে বর্তমানে সফলতার গল্পের উপকরণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কার কতো এক্সপোজার, কে কতবার হজ্ব বা ওমরা করলেন, মস্ত বড়ো গরু কোরবানি কে দিলেন, বিদেশে কার কয়টা বাড়ী রয়েছে, কে বিসিএস উত্তীর্ণ হলো, কার সরকারি চাকুরী হলো, এ হলো বর্তমানে সফলতার নমুনা। এটা একেবারে হিসাব করা হয় পার্থিব অর্জনে, যেখানে মানবতার ছোয়াঁ নেই বললেই চলে।
কারন এমন সফলতা বা সফল মানুষ বর্তমানে সবাই দেখতে চাই। এখনকার মা-বাবারাও তার সন্তানের আয়-রোজি ভালো হলে সন্তানকে সফল মনে করে। স্কুলের শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের আর্থিক উন্নয়নকে সফলতা হিসাবে দেখে ও অন্য শিক্ষার্থীদের উপমা দেয়। টাকার পাহাড় গড়া মানুষগুলো আজকাল সব জায়গায়, সর্বত্রই সমাদৃত। বিয়ে বাড়ীতে, বাজার-ঘাট সর্বস্থানে ধনীর কদর যেন একেবারে সাধারণ ব্যাপার। শিক্ষা অর্জন করে ভালো আয় রোজগার না করতে পারলে তাকে আজ আর সফল ভাবা হয়না। তাই এমন অসম প্রতিযোগিতার যুগে ন্যায় পরায়ন মানুষ পাওয়া বড়ই দুষ্কর। সৎ মানুষের আবির্ভাব খুবই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।
সদ্য খবর আজ, আমেরিকায় এদেশের ২৫২ জন সরকারি আমলা ও কর্মকর্তার বাড়ী রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে থানা পর্যায়ের ওসি সাহেবদেরও বাড়ী। আমেরিকায় বাড়ী করা নিশ্চয়ই কম টাকার বিষয় নয়। একজন সরকারি বেতনের ওসি সাহেবরা এ টাকা কয় পেলেন? কত তার বেতন? বাংলাদেশের সরকারি সর্বোচ্চ বেতন পান রাষ্ট্রপতি। তিনিও কি তার অর্জিত বেতনে আমেরিকায় বাড়ী করতে পারবেন? তাহলে কি করে এ আমলা, কর্মকতারা সহজে আমেরিকায় বাড়ী করেন? এ টাকা কার? কোথায় পেলেন? আসলে মানুষ তার পার্থিব স্বার্থ অর্জনে ধাবিত। কারণ সফলতার গল্পে এসেছে পরিবর্তন। পরিবর্তন হয়েছে মনুষ্য রুচিতে। রয়েছে একাল ও সেকালের বহুত তফাৎ।
তবে সফলতার গল্পে মুসলমানদের জন্যে রয়েছে ভিন্ন বার্তা। ইসলাম বলে সফল হলো সে ব্যাক্তি যিনি তার কর্মে কারো হক নষ্ট না করেন। সফল হলো সে ব্যাক্তি যিনি তার সময়ের দাম দেন ও সময়ের সঠিক ব্যবহারে পরকালের কল্যানার্থে ভালো কাজ করেন। পরকালের ছাওয়াব অর্জিত হবার প্রতিটি কাজ হলো মুসলমানদের জন্যে প্রকৃত সফলতা। আর একজন মুমিনের সর্বোচ্চ সফলতা হলো পরকালে নাজাত পেয়ে জান্নাতের বাসিন্দা হওয়া, যেখানে রয়েছে পরিপূর্ণ শান্তির আয়োজন।
লেখক- সাজজাদুল ইসলাম রিপন
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি (বি.আই.ইউ) এ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন।