মাওলানা ম‌ওদূদী (রহ.) কি হাদিস অস্বীকারকারী ছিলেন? (একটি অপবাদ ও জবাব)

মাওলানা ম‌ওদূদী (রহ.) কি হাদিস অস্বীকারকারী ছিলেন?

মাওলানা মতিউর রহমান মাদানী ও তাঁর অনুসারীরা মাওলানা ম‌ওদূদীর উপর যে কয়েকটা জঘন্য নোংরা অপবাদ দিয়ে তাঁর চরিত্রে দাগ দেবার চেষ্টা করছে, তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে ম‌ওদূদী কর্তৃক হাদিস অস্বীকার করা। মানুষের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া এবং বুঝেশুনে তিলকে তাল বানিয়ে কারো চরিত্র হনন করার চেষ্টা করা কোন সহিহ হাদিসের আলোকে জায়েজ জানতে চাই।


এখন আমরা তাদের এই মিথ্যাচারের জবাব দিব ইনশাআল্লাহ।


প্রথমেই জেনে রাখতে হবে যে, উসুলের উপর যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে হাদিস অস্বীকার করা আর দলিল ও উসুল মানা সত্বেও অসংখ্য হাদিসের মধ্যে ২/৪ টা সহিহ হাদিসের উপর আপত্তি তুলা এক জিনিস নয়। প্রথমটা নিন্দনীয় এবং অবশ্যই পরিত্যাগযোগ্য। কিন্তু দ্বিতীয়টা দোষণীয় নয়। মুহাদ্দিসগণ কর্তৃক অনুসৃত নীতির খেলাফ‌ও নয়। এমন অনেক হাদিসের খোঁজ পাওয়া যায় যেগুলো হাদিস বিশারদগণের কাছে সনদের দিক থেকে সহিহরূপে স্বীকৃত। কিন্তু হাদিসের বিষয়বস্তু, অকাট্য উক্তি কিংবা মুক্ত জ্ঞানের সুস্পষ্ট বিরোধী হওয়ার কারণে হাদিস বিশারদগণ সেগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রত্যাখ্যান করেছেন। উসুলে হাদিস সম্পর্কে সামান্য জানাশোনা থাকলেও কেউ এটাকে 'হাদিস অস্বীকার করা' বলতে পারে না। যেমন দেখুন:


১. সহিহ বুখারির ৭৫১৭ নম্বর হাদিসে রাসুল সা.-এর মেরাজের ঘটনা নিয়ে লম্বা হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এই হাদিসের শুরুতে বলা হয়েছে, মেরাজ ঘটেছিল নবুওয়ত পাওয়ার পূর্বে। 


এটার উপর আলেমগণ তুমুল জারাহ করেছেন। উমদাতুলকারী গ্রন্থে আল্লামা বদরউদ্দিন আইনি ইমাম নববীর উক্তি নকল করে বলেন, 


 قال النووي: جاء في رواية شريك أوهام، أنكرها العلماء من جملتها أنه قال ذلك قبل أن يوحي إليه، وهو غلط لم يوافق عليه. العلماء أجمعوا على أن فرض الصلاة كان ليلة الاسراء، فكيف يكون قبل الوحي؟

"শারিক বিন আব্দুল্লাহর বর্ণনায় বিভ্রান্তি রয়েছে , যা আলেমগণ হাদিসের এই অংশকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে যে, মেরাজের ঘটনা ছিল অহি নাজিলের পূর্বে। এটা গলদ ও ভ্রান্ত, সমর্থনযোগ্য নয়। আলেমগণ সর্বসম্মতভাবে একমত যে, সালাত ফরজ হয়েছে মেরাজের রাত্রে। তাহলে কীভাবে এটা নবুওয়তের পূর্বে হতে পারে?


একটু অগ্রসর হয়ে আইনি বলেন,


قوله: "قبل أن يوحي إليه" أنكرها الخطابي وابن هزم وعبد الحق والقاضي عياض والنووي

সহিহ বুখারির হাদিস "রাসুল সা. -এর কাছে নবুওয়তের আগে তিনজন ফে‌রেশতা এসেছিলেন মর্মে বক্তব্যটি ইমাম খাত্তাবি, ইবনে হাজম, আব্দুল হক, কাজী আয়াজ ও ইমাম নববী প্রত্যাখ্যান করেছেন।"

(উমদাতুল কারী, ২৫/১৭১)


এক‌ই হাদিসের মাঝের এক অংশের উপর ইমাম খাত্তাবি কঠোর সমালোচনা করেছেন। হাদিসে বলা হয়েছে 


دنا الجبار فتدلى حتى كان منه قاب قوسين أو أدنى

"রাসুল সা. সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছার পর আল্লাহ তাআলা তাঁর নিকটবর্তী হলেন। এতো নিকটবর্তী যে, তাঁদের মাঝে দুই ধনুকের পার্থক্য র‌ইল অথবা আরও কম।" 


আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি বলেন যে, ইমাম খাত্তাবি বলেছেন,


حديث أشنع ضاهرا ، ولا أشنع مزاقا هذا الفصل.

"সহিহ বুখারির হাদিসের এই বক্তব্য প্রকাশ্যভাবে অধিক আপত্তিকর। এই ব্যাপারে এর চেয়ে আপত্তিকর আর কিছু হতে পারে না" (ফাতহুল বারী, ৪/৪৮৩)


কেননা, সূরা নাজমে এই সংক্রান্ত আয়াতের তাফসিরের ব্যাপারে মুফাসসিরগণ একমত যে, নিকটবর্তী হয়েছেন বলতে জিবরাঈল আ.-কে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ জিবরাঈল আ. রাসুলুল্লাহ সা.-এর নিকটবর্তী হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুই ধনুকের থেকেও কম ফারাক ছিল। কিন্তু এই হাদিসে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা নিকটবর্তী হয়েছেন। তাই ইমাম খাত্তাবি বলেন, 


إن الذي وقع في هذه الرواية من نسبة التدلي للجبار مخالف لعامة السلف والعلماء وأهل التفسير من تقدم منهم ومن تأخر

"এই বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা নিকটবর্তী হ‌ওয়ার যে বিষয়টি রয়েছে তা সমস্ত সালাফ, আলেম, মুফাসসির, মুতাকাদ্দিমিন ও মুতা‌আখখিরিনদের মতের বিপরীত।" (ফাতহুল বারী, ৪/৪৮৪)


আবার এই হাদিসের শেষে বলা হয়েছে,


ويستيقظ وهو في المسجد الحرام

"এ সময় তিনি জাগ্রত হলেন আর দেখলেন তিনি মসজিদে হারামে আছেন।" 


এই অংশের উপর‌ও খাত্তাবিসহ কেউ কেউ আপত্তি তুলেছেন। কেননা, এই কথার দ্বারা বাহ্যত মনে হয় মেরাজ স্বপ্নে হয়েছিল।


এখন প্রশ্ন হচ্ছে এক‌ই হাদিসের বিভিন্ন অংশের উপর যে অনেকেই আপত্তি তুললেন, প্রত্যাখ্যান করলেন , তাহলে তারা কি হাদিস অস্বীকারকারী? নাকি এরা শিয়া কিংবা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের বহির্ভূত কোনো সম্প্রদায়?


২. তাদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হজরত সুলাইমান আ.-এর স্ত্রীর সংখ্যা বুখারি শরি‌ফে বিভিন্নভাবে উল্লেখ থাকার কারণে সেটা মাওলানা ম‌ওদূদী অস্বীকার করেছেন। অথচ এর আগেও এই হাদিস নিয়ে বহু মনীষী সমালোচনা করেছেন। শাফেয়ি মাযহাবের একজন বিখ্যাত ইমাম আল্লামা আবু মুসা আল মাদীনী রহ. এই হাদিসের সমালোচনা করে বলেন,


قصة سليمان هذا الاختلاف في هذا العدد وليس هو من قول النبي صلى الله عليه وسلم وإنما هو من الناقلين

"সুলাইমান আ.-এর স্ত্রীদের সংখ্যার মতবিরোধে প্রমাণ হয়, এটা রাসুল সা.-এর বক্তব্য নয় বরং এটা বর্ণনাকারীদের কথা।" (ফাতহুল বারী, ১১/৬০৬)


এখন তিনি কি হাদিস অস্বীকারকারী? তাহলে তার ব্যাপারে কথিত মুফতিগণ চুপ কেন? তাদের চোখ শুধু মাওলানা ম‌ওদূদীর দিকে কেন? এটা কি উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়?


৩. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনু উমর রা.-এর থেকে বর্ণিত একটা হাদিসের ব্যাপারে ইমাম ইবনু আব্দুল বার রহ. বলেন,


حديث ابن عمر وهم وغلط، وأنه لا يصح معناه، وإن كان إسناده صحيحا.

"ইবনু উমরের বর্ণিত হাদিসটি উদ্ভট কল্পনা প্রসূত ও ভ্রান্ত। এর বক্তব্য সঠিক নয় যদিও তার সনদ নির্ভুল।"(ইবনু আব্দুল বার, আল ইস্তিয়াব, ৩/১১১৬)।


এইরকম আরো বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে সনদ সহিহ হ‌ওয়া সত্বেও মতন নিয়ে উলামায়ে কেরাম আপত্তি করেছেন। এতে তাঁরা কেউ হাদিস অস্বীকারকারী হননি। এই ভাগ্য জুটল কেবল মাওলানা ম‌ওদূদীর কপালে। অথচ এই মনীষী হাদিস অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে "সুন্নাতে রাসূ‌লের আইনগত মর্যাদা" নামক প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করে তাদের দাঁতভাঙা জবাব দেন। এরপরও তাঁর বিরুদ্ধে হাদিস অস্বীকার করার অপবাদ দেওয়ার মতো বড় জুলুম আর কী হতে পারে?


উসুলে হাদিসের উপর জানাশোনা আ‌ছে এমন প্রত্যেকেই জানেন, রেওয়াআত ও দেরায়াত হাদিসের দুটি পরিভাষা। দেরায়াত মানেই হচ্ছে সনদ শুদ্ধ হলেও মতন বা হাদিসের মূল বক্তব্য ঠিক আছে কিনা যাচাই বাছাই করা। সনদ শুদ্ধ হলেই যদি সেই হাদিস অন্ধভাবে গ্রহণ করতে হয় তাহলে উসুলে হাদিসে "দেরায়াত" নামক আলাদা পরিভাষা সৃষ্টি করা হলো কেন? আর কেনইবা মুহাদ্দিসগণ বুখারির মতো বিশুদ্ধ কিতাবের‌ও কিছু হাদিসের উপর আপত্তি তুলেছেন?


এর সহজ উত্তর হচ্ছে, সনদ সহিহ হ‌ওয়ার কারণে ইমাম বুখারি তাঁর সহিহ গ্রন্থে হাদিসটি নিয়ে এসেছেন কিন্তু এর মতন বা মূল বক্তব্য বাস্তবতাবিরোধী, অন্যান্য হাদিস বা কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক, রাসুল সা.-এর শানের খেলাফ বা ভাষাগত দোষে দুষ্ট কিংবা অন্য কোনো কারণে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। 


এমন হাদিসের উপর মুহাদ্দিসগণ জারাহ করেছেন। এমনকি এই জারাহ ও দেরায়াতগত পরীক্ষা নিরীক্ষার সূচনা সাহাবিদের যুগ থেকেই শুরু হয়। যেমন, সহিহ বুখারির হাদিসে ইবনু উমর রা. বলেছেন, 


إن الميت ليعذب ببكاء أهله عليه

"পরিবারের লোকদের বিলাপের কারণে মৃত ব্যক্তির ওপর আজাব হয়।"


এটা যুক্তি বিরোধী এবং কুরআনের সাথেও সাংঘর্ষিক তাই হজরত আয়শা সিদ্দিকা রা. এটা শোনার পর বললেন, ইবনে উমরের বক্তব্য সঠিক নয়। তিনি রাসুলুল্লাহর কথার মর্মার্থ বুঝতে পারেননি।


হজরত আয়েশার জবাবটাও সহিহ বুখারিতে এসেছে। অর্থাৎ সনদ সহিহ হ‌ওয়ার কারণে ইমাম বুখারি বিপরীতমুখী দুইটা হাদিস‌ই তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন কিন্তু একটা বাস্তবতাবিরোধী হওয়ার কারণে হজরত আয়েশা প্রত্যাখ্যান করেছেন। হজরত সুলাইমান আ. এক রাতে, ৭০, ৯০, ১০০ স্ত্রীর কাছে যাওয়া‌ও বাস্তবতা বিরোধী। তাছাড়া শুধু সহিহ বুখারিতেই একেকটা হাদিসে একেকটা সংখ্যা উল্লেখ রয়েছে। এইজন্য মুহাদ্দিসগণ এই হাদিসের‌ও সমালোচনা করেছেন।


এইভাবে মুহাদ্দিসগণ‌ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যুক্তির নিরিকে সনদ সহিহ হ‌ওয়া সত্তেও কোনো কোনো হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদীও রহ‌. এর ব্যতিক্রম নয়। অত‌এব, এটাকে হাদিস অস্বীকার করা বলা চরম জাহালতি ছাড়া আর কিছু নয়।


লেখক- শায়খ আসলাম হোসাইন,

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া থেকে আল-হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম