বিশ্বব্যাপি সমাজতন্ত্রের চাহিদায় ভাটা পরতে না পরতে দেশে দেশে মানুষের কল্যানে জনপ্রিয় নীতি হলো 'গনতন্ত্র'। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সংবিধানেও ঠাঁই পেলো এ গনতন্ত্র। আর দেখানো মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রামে শহীদ ও জনগনের অন্যতম অভিপ্রায় এ গনতন্ত্র হলো রাষ্ট্র পরিচালনা নীতি সমূহের প্রথম নীতি। কিন্তু এ দেশে সংবিধান গৃহীত হবার পরবর্তী সময়ে এ নীতি তথা গনতন্ত্র বার বার হোচট খেলো শুধুমাত্র দলগুলোর ক্ষমতায় থাকার অধিক আগ্রহে ও হীন মানসে। তাই গনতন্ত্র রয়ে গেলো দেশের মানুষের কাছে স্বপ্নের মত। সকল ক্ষমতার উৎস জনগন এটা কেবল সাংবিধানিক বুলিতে পরিনত হলো। কখনো টিকসই গনতন্ত্রের ধারাবাহিকতা দেশের মানুষ নিশ্চিন্তে ভোগ করতে পারেনি বা নীতি-নির্ধারকরা তাদের ভাবনায়ও রাখেনি এমন চিন্তা-চেতনা।
এ দেশের এ গনতান্ত্রিক ধারার প্রধান অন্তরায় হলো সময়ে সময়ে ক্ষমতাসীন দল গুলোর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কু মানসে করা সকল ষড়যন্ত্র ও কুচর্চা। বিরোধী দলে থেকে গনতন্ত্রের জন্যে বিভিন্ন খেতাব অর্জনকারী দলের নেতা-নেত্রীরাই আবার ক্ষমতা পেলে রাতারাতি ভুলে যায় সবকিছু। তাই গনতন্ত্রের মায়া কান্না সকল বিরোধী দল চর্চা করে গেলেও, ক্ষমতা এসে ঐ দলই আবার গনতন্ত্রের দ্বারগুলো বন্ধ করে দিয়ে দেশের মানুষকে করেন বাকরুদ্ধ, কারাবদ্ধ। কি দুর্ভাগ্য এ দেশের জনগণের! টিকসই গনতন্ত্রের আন্দোলন বা চেষ্টা কখনো কোনো দল করেনি। গনতন্ত্র সমুন্নত রাখতে অন্যতম ভূমিকায় যেতে পারে ক্ষমতাসীন দল। কারন এমন গনতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার সকল কৌশল ও কলকব্জা তাদের হাতেই থাকে। তাই সত্যিই দরকার একজন নেলসন মেন্ডেলার!
স্বাধীনতার প্রায় ২০ বছর পর অনেক আন্দোলনের মুখে গনতন্ত্র এ দেশে কিছুটা তার অবয়বে এসেও ধাক্কা খেয়েছে বার বার। ৯৬ এর নির্বাচন পূর্বে আবার শুরু হলো গনতান্ত্র পুনঃউদ্ধারের আন্দোলন। তৈরি হলো গনতন্ত্র ঠিক রাখার জন্যে নির্বাচন সময়ে অগণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার প্রচলন। রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি প্রবল অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার কারনেই এমন সরকার ব্যবস্থার বিকল্প এদেশের মানুষের হাতে কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা। কেয়ারটেকার সরকারের অধীন কিছুটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের ছোঁয়া পেলো দেশের সাধারন মানুষ। তেমনিভাবে ২০০১ সালের নির্বাচনকে অনেকটা নিরপেক্ষ নির্বাচন বললেই খুব একটা ভুল হবেনা। ২০০৬ সালে আবার নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে শুরু হলো সংকট। প্রশ্নবিদ্ধ হলো কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা।
কেয়ারটেকার সরকার প্রধান নিজেদের পছন্দ মত করতে তদানীন্তন সরকার সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অবসরে যাবার বয়স বাড়ালে, সে সময়ের বিরোধী দল শুরু করে তাদের আন্দোলন। আবারো শুরু হয় গনতন্ত্র রক্ষার নামে আন্দোলন। বলতে গেলে বিগত ২ বারের নিরপেক্ষ অন্তবর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা মূহুর্তে হয়ে উঠে প্রশ্নবিদ্ধ। এমনি ভাবে ওয়ান-এলেভেনের সরকার এসে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দোহাই দিয়ে সংবিধানে বর্নিত সময়ের অতিরিক্ত সময় ক্ষমতায় থেকে সৃষ্টি করেছে নতুন আতংক। ২০০৮ সালে নির্বাচনে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে অন্তবর্তী সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। নির্বাচন কালীন সরকার হবে ক্ষমতাসীন দল। এখান থেকে শুরু হয় গনতন্ত্র উদ্ধারের পুনঃ আন্দোলন।
এ দেশের ভাগ্যোন্নয়নে গনতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু এমন মহান কাজটি করার ক্ষমতাসীন দলের নিরপেক্ষ ভূমিকা এদেশের মানুষ আজো দেখেনি। বিষয়টিতে যদিও বিরোধী দলগুলো আজীবন আহাজারি করে গেছে। কিন্ত ক্ষমতায় গিয়ে কমবেশি এ সকল বিরোধী দল গনতন্ত্রকে শ্বাসরোধে হত্যায় ছিল মরিয়া। অপরদিকে এমন গনতন্ত্র রক্ষার দোহাই দিয়ে বিদেশী শক্তিগুলো এদেশের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে যার সুযোগ তৈরি করে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। কখনো টিকসই গনতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় এ দেশ সুপ্রতিষ্ঠিত করার সঠিক প্রয়াস কেউ দেখায়নি। তাই প্রতিবার নির্বাচন আসলে এ দেশে তৈরি হয় নতুন আতংক ও গনতন্ত্র চর্চার ঝনঝনানি।
এদেশের সাধারন জনগণ কখনো তার ভাগ্য উন্নয়নে বিদেশীদের দ্বারস্থ হতে চাই না। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলগুলোর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার হীন মানসেই তারা এই সুযোগ পায় বিরোধী দলগুলোর সমর্থনে। আর বিদেশীরাও তখন তাদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় থাকে শতভাগ। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-নেত্রীর কথায় যা মাঝেমাঝে অকপটে বের হয়ে আসে। আসলে শক্তিশালী গনতন্ত্রের চর্চার চাবিগুলো হলো এদেশের সরকারি ও বিরোধী দলের হাতে। কেবলমাত্র ক্ষমতাসীন দলকে উৎখাত করার চেয়ে টিকসই গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে আন্দোলন হওয়া উচিত সকল মহলের, সকল রাজনৈতিক দলের। কারন স্বাধীনতার এতবছর পরও আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচনের ফর্মূলা নির্ধারন করতে না পারাটা আসলেই এ দেশের প্রধান ব্যর্থতা।
লেখক- সাজজাদুল ইসলাম রিপন
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি (বি.আই.ইউ) এ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন।