বর্তমানে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্য মালিকানায় থাকলেই কি যাকাত ওয়াজিব হয়ে যাবে?

বর্তমানে সময়ে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা তার সমমূল্য সম্পদ মালিকানায় থাকলেই কি যাকাত ওয়াজিব হয়ে যাবে?

বর্তমানে সময়ে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা তার সমমূল্য সম্পদ মালিকানায় থাকলেই কি যাকাত ওয়াজিব হয়ে যাবে? এ প্রশ্ন এখন বেশ গুরুত্ব বহন করে। কেননা বর্তমান সময়ের রূপার মূল্য ও অতীতের রূপার মূল্যের সাথে বিরাট একটা তফাত লক্ষণীয়। তাই এ নিয়ে বর্তমান সময়ের বিদগ্ধ আলিমদের ও গবেষকদের ব্যাপক গবেষণা করা প্রয়োজন এমনই মনে করছেন তরুণ ইসলামী লেখক, আলিম ও গবেষক শায়খ আসলাম হোসাইন।


তাই ফেসবুকের এক পোস্টে শায়খ আসলাম হোসাইন 'সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্য মালিকানায় থাকলেই কি যাকাত ওয়াজিব হয়ে যাবে?' এ শিরোনা'মে তিনি লিখেছেন-


যাকাত আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি ফরজ বিধান। কেউ এটা অস্বীকার করলে সে কাফের হয়ে যাবে। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে শরিয়তে বর্ণিত বিষয় বস্তুর ওপর যাকাত দেওয়া ফরজ। এইসব বিষয় বস্তুর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সোনা এবং রুপার নিসাব। কারো মালিকানায় সাড়ে সাত ভরি সোনা কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা তার সমমূল্য সম্পদ এক বৎসর অতিবাহিত হলে ‌সে ব্যক্তিকে যাকাত দিতে হবে।


ফকিহদের মতামত হচ্ছে, কাগজের নোটের টাকা সোনা-রুপা দিয়ে হিসাব করতে হবে এবং যেটা দিয়ে হিসাব করলে সহজেই যাকাত ফরজ হয় সেটা ধরতে হবে। কারণ এতে গরিবদের প্রতি বেশি ইনসাফ হয়। অর্থাৎ বাজারে যদি রুপার দাম কম হয় তাহলে রুপার দিকে হিসাব করে যাকাত দিতে হবে আর সোনার দাম কম হলে সেটাকে ধরে যাকাত হিসাব কর‌তে হবে।


এই নীতির উপর ভিত্তি করে রুপার দাম তথা ৬০ হাজার টাকা থাকলে যাকাত দিতে বলা হয়। কিন্তু আমি ম‌নে ক‌রি বর্তমান পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা যাকাতের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করা। কিন্তু এই টাকায় যাকাত ফরজ সাব্যস্ত করলে বৈষম্য দূর হচ্ছে নাকি আরো বৈষম্য তৈরি হচ্ছে? সেটা দেখার বিষয়। তাছাড়া এখানে আরো কয়েকটা বিষয় লক্ষণীয়। যেমন:


১. যখন ফকিহগণ গরিবের উপকারিতার কথা ভেবে রুপার দিকে হিসেব করতে বলেছেন তখন সোনা-রুপার দাম কাছাকাছি ছিল কিন্তু বর্তমানে রুপার দামের এত অধঃপতন হয়েছে যে, বর্তমান বাজারে এটার কোনো মূল্যই নেই।


২. ফকিহগণ গরিবদের উপকারের কথা চিন্তা করেই এই ফতোওয়া দিয়েছেন, যাতে করে গরিবরা বেশি উপকৃত হয় কিন্তু বর্তমানে এই সামান্য টাকার উপর যাকাত ধার্য করলে গরিবরা উপকৃত হয় না বরং তারা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা বর্তমানে যারা গরিব, মিসকিন, ফকির এমনকি ভিক্ষা করে খায় তার কাছেও ৫০/৬০ হাজার টাকা থাকে বালা-মুসিবতসহ যে কো‌নো কাজে লাগানোর জন্য। আবার এমন অনেকেই আছে, না খেয়ে টাকা ৬০০০০ ব্যাংকে রাখে তার মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। এমতাবস্থায় তার এই টাকার উপর যদি যাকাত ধার্য করা হয় তাহলে সেটা أنفع الفقراء থেকে أضر الفقراء এ পরিণত হয়।


৩. সহিহ বুখারিতে বলা হয়েছে- 

ليسَ فِيما أَقَلُّ مِن خَمْسَةِ أَوْسُقٍ صَدَقَةٌ 'পাঁচ ওয়াসাক তথা প্রায় ২৮ মণ ৫ সের (ইরাকী ওজনে) এর নিচে উৎপন্ন দ্রব্যের উপর জাকাত নেই।'


এই হাদিসের ব্যাখ্যায় শাহ অলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.) 'আল হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ' গ্রন্থে বলেন, 'ফসলের ক্ষেত্রে পাঁচ ওয়াসাক নির্ধারণ করার কারণ হলো, এর কম পরিমাণ একটা পরিবারের সারা বছরের প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট নয়।' তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে একটা সিঙ্গেল পরিবারের জন্য ৫০/৬০ হাজার টাকা কি এক বছরের জন্য যথেষ্ট?


৪. আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করতে হবে নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত। যেমন কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

ويسئلونك ماذا ينفقون قل العفو 'লোকেরা জিজ্ঞেস করে তারা কী খরচ করবে? আপনি বলে দিন যা অতিরিক্ত ।' (সুরা বাকারা-২১৯) হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, অতিরিক্ত বলতে বোঝায় পরিবার বহনের সব দায়িত্ব পালনের পর যা অবশিষ্ট থাকবে তা। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)। 


৫. একজন ব্যক্তি তার নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য এক বছরের খরচ রেখে অতিরিক্ত গুলো আল্লাহ তাআলার রাস্তায় ব্যায় করবে। কিন্তু ৬০ হাজার টাকা দিয়ে একটা পরিবার সর্বোচ্চ তিন মাস চলতে পারে। বাকি নয় মাস তো তাকে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। এমতাবস্থায় তার উপর যাকাত ধার্য করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত?


৬. এক ব্যক্তি এসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমার কাছে একটি মাত্র মুদ্রা আছে, রাসুলুল্লাহ বললেন– তা তুমি নিজের জন্য ব্যয় করো। আমার কাছে আরও একটি আছে। বললেন–তা তোমার স্ত্রীর জন্য ব্যয় করো। বলল আমার কাছে আরও একটি আছে। বললেন–তা তোমার সন্তানের জন্য ব্যয় করো। বলল, আমার কাছে আরও একটি আছে। বললেন– তুমি নিজেই বুঝ। (আল হাদিস)


এখান থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, ব্যক্তি‌কে নিজের, তার স্ত্রী ও সন্তানের প্রয়োজন সর্বাগ্রে পূরণ করতে হবে। কিন্তু ৬০/৭০ হাজার টাকা কি এক বছরের জন্য এইসব পূরণের জন্য যথেষ্ট?


৭. যাকাত দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা বিশেষ নেয়ামত। আর নেয়ামত দিতে হয় সন্তুষ্টচিত্তে। যেমন হাদিস শরিফ-এ বর্ণিত হয়েছে, ادوا زكاة أموالكم طيبة بها أنفسكم 'তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদের যাকাত দাও তোমাদের মনের সুখ ও সন্তুষ্টচিত্তে।' কিন্তু যে অভাবগ্রস্ত সে এই টাকা থেকে কি সন্তুষ্টচিত্তে দান করতে পারবে?


৮. অনেক ইতিহাসবিদ বলেছেন, সেকালে দশ দিরহাম রৌপ্য দিয়ে এক দিনার স্বর্ণ ভাঙ্গানো হতো। হাদিসও তাদের এই মতকে সমর্থন করে। যেমন,

في كل سائمة دينار أو عشرة دراهم 'প্রতিটি উন্মুক্ত ঘোড়ার যাকাত ১ দিনার অথবা ১০ দিরহাম'। (শাওকানী, নাইলুল আওতার- ১৯৮)


এখান থেকে বুঝা যায় তখন এক দিনার দশ দিরহামের সমান ছিল। এইজন্য তো রসুলুল্লাহ (সা.) ২০ দিনার (স্বর্ণ) এর সাথে ২০০ দিরহাম (২০*১০) রৌপ্য যাকাতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, তখন ২০ দিনার তথা সাড়ে সাত ভরি সোনা এবং ২০০ দিরহাম তথা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার দাম সমান ছিল।


কিন্তু বর্তমানে কি দুইটার দাম সমান অথবা মোটামুটি কাছাকাছি?


৯. তাছাড়া শরিয়তে ৫ টি উট, ৩০ টি গরু, ৪০ টি ছাগলের ওপর যাকাত ধার্য করেছে। এখন ৫ টি উট, ৩০ টি গরু ও ৪০টি ছাগল- এর প্রত্যেকটির দাম কমপক্ষে ৬/৭ লক্ষ টাকা হবে। আর সাড়ে সাত তোলা সোনার বর্তমান বাজার দাম‌ও প্রায় অনুরূপ। সবগুলোর দাম মোটামুটি একটা আরেকটার কাছাকাছি। কিন্তু একমাত্র রুপার দামের এত অধঃপতন ঘটেছে যে, এটা সেইগুলোর পাশে দাঁড়ানোর‌ও ক্ষমতা রাখে না।


১০. শরিয়ত এসেছে বৈষম্য দূর করার জন্য। এখন এটা কিভাবে কল্পনা করা যায় যে, কারো কাছে ২৯টা গরু তথা ৬ লক্ষ টাকার সম্পদ থাকলে শরিয়ত তাকে গরিব সাব্যস্ত করেছে। অপরদিকে মাত্র ৬০/৭০ হাজার টাকা ঘরে থাকলে শরিয়ত তাকে ধনী সাব্যস্ত করে তার উপর যাকাত ফরজ করে দিয়েছে, অথচ এই টাকা দিয়ে সে দুইটা গরুও কিনতে পারবে না। তাহলে কি বৈষম্য দূর করা হলো, নাকি আরো বৈষম্য তৈরী হলো? এমন বৈষম্যমূলক হিসাব শরিয়ত দিতে পারে বলে ভাবা যায়?


সর্বশেষে কথা হচ্ছে,


তখন সোনা রুপার দাম মোটামুটি কাছাকাছি ও মানসম্মত ছিল বলে রুপার দিকে হিসেব করা হয়েছে কিন্তু বর্তমানে রুপা মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। বিশ্ববাজারে তো রুপার কোনো দামই নেই। এমতাবস্থায়‌ও এটার দিকে হিসাব করে জাকাত ধার্য করতে হবে কিনা সে বিষয়ে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। ড. ইউসুফ আল-কারযাভী (রহ), সাইয়্যেদ সালিম (রহ.) সহ আধুনিক যুগের অনেক ফকিহ রুপার দিকে হিসাব না করে সোনার দিকে হিসেব করার পক্ষে ফতোওয়া দিয়েছেন। তবে কেউ যদি রুপার দিকে হিসাব করে যাকাত দেয় তাহলে এটা সবচেয়ে ভালো, অধিক নিরাপদ এবং প্রশংসনীয়। কিন্তু তাকে বাধ্য করা যাবে কিনা? এই ব্যাপারে গবেষণার প্রয়োজন।


প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা ঘরে থাকলে যাকাত দিতে হবে কিনা? উত্তর হচ্ছে, এর যাকাত দিতে হবে। কেননা রূপার নির্দিষ্ট পরিমাণের ওপর যাকাত দেওয়ার কথা হাদিসে রয়েছে তাই এটার ওপর গবেষণা ও যুক্তি অবতারণার ‌কো‌নো সুযোগ নেই। কিন্তু নগদ অর্থের বেলায় হাদিসে এটা বলা হয় নি যে, রুপার দিকে হিসাব ধরা হবে কিংবা বাজারে যার মূল্য কম তার দিকে ধরা হ‌বে। হাদিসে এমন কথা থাকলে সেটাই নির্ধারিত হতো। কিন্তু এটা আলেমদের ইজতেহাদ মাত্র। আর ইজতেহাদের দরজা সবসময় খোলা এবং এটা সময়ের আবর্তনে পরিবর্তন‌ও হতে পারে। তাই সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এটা নিয়ে নতুনভাবে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে ব‌লে আ‌মি মনে ক‌রি।

লেখক- শায়খ আসলাম হোসাইন,

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া থেকে আল-হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।

1 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম