এ কথা প্রচলিত আছে যে ডাক্তার আর এডভোকেট এর কাছে কেউ সেচ্ছায় যেতে চাইনা। কিন্তু কারো বাস্তব পরিস্থিতিতে এমন পেশাজীবির কাছে না গিয়েও পারেনা। আমাদের দেশে চিকিৎসা সেবা পাওয়া একটা মৌলিক অধিকার না হলেও সকলের সমান আইনের আশ্রয় লাভ সরাসরি মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভূক্ত। তাই চিকিৎসায় রয়ে গেছে বিস্তর বৈষম্য। তাছাড়া সরকারি চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা সুলভ মূল্যে চিকিৎসা না পাওয়ার অন্যতম কারন। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিবেচনায় এদেশের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সমান সুযোগ মৌলিক অধিকারের মর্যাদা এখনো পায় নি। ফলে চিকিৎসা সেবাই রয়েছে নানা অভিযোগ ও অনিয়ম।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসার অবাধ সুযোগ না থাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে যত্রতত্র হাসপাতাল। এ হাসপাতাল গুলোর মান ও চিকিৎসা সেবা নিয়ে রয়েছে আবার নানান অভিযোগ। ফলে চিকিৎসা সেবায় সাধারন মানুষের আস্থা তৈরি হওয়া এখনো সময়ের ব্যপারমাত্র। কারন এমন অনাস্থার কারনে এ দেশের বছরে কোটি কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে শুধুমাত্র সুচিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকার কারনে। সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয় হলো বড় বড় রাজনীতিবিদ ও সম্পদশালী রা কেউ এদেশের চিকিৎসায় এখন আর আগ্রহী নন। এতে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্র হারাচ্ছে রেভিনিয়ু।
ডাক্তার ফি নির্দিষ্ট হবার কারনে অনেকক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ তার পছন্দ মত চিকিৎসকের পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হন। এছাড়া অনেকে ধারণা করেন যে আমাদের দেশের ডাক্তার সমাজ চিকিৎসার নামে অনেক ডায়াগনস্টিক টেস্ট এর রেফারেন্স / প্রেসক্রিপশন দেন শুধুমাত্র নিজেদের আর্থিক লাভে যা রীতিমতো মানুষের ভোগান্তিকে একধাপ বাড়িয়ে দেয়। এমন ভোগান্তি এড়াতে খেয়ালীপনা সাধারন মানুষ মাঝেমাঝে নিজেরাই নিজেদের রোগের লক্ষন বিবেচনায় অথবা ফার্মেসীর সাথে যোগাযোগ করে ঔষধ সেবন করেন যা মানুষের শারীরিক অবস্থাকে আরো জটিল করে তোলে। তাছাড়া বাজারজাত সকল ঔষধের মান নিয়েও রয়েছে তর্ক, বিতর্ক।
সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় হলো চিকিৎসা সেবায় একদর সিস্টেম। কারন এই সিস্টেমে একজন শুধুমাত্র আর্থিক অসচ্ছল হবার কারনে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হন যা একেবারে অমানবিক। কিন্তু এ অমানবিক চিত্রই আমাদের নিত্য দিনের চিত্র ও হ্রদয়বিদারক বিষয়। চিকিৎসা সেবার অবশ্যই একটা সুনির্দিষ্ট খরচ রয়েছে। কিন্তু এমন খরচ বহন করা সকলের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে দরকষাকষির একটা সুযোগ থাকা উচিত। তাহলে এ খরচ বহনের সামর্থ অনুযায়ী প্রত্যেকে চিকিৎসার সুযোগ পাবে এবং একটা মানবিক অবস্থার সৃষ্টি হবে। কারণ প্রকৃত বিবেচনায় চিকিৎসা প্রদান শুধুমাত্র একটা লাভজনক ব্যবসা নয়, বরং একটা সেবাও বটে।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগবে, তাহলে চিকিৎসা সেবার নূন্যতম খরচ কে বহন করবে? এমন খরচ মিটানোর জন্যে প্রতিটা চিকিৎসালয় এ একটা করে ফাউন্ডেশন থাকা উচিত যেখান থেকে এ খরচ যোগানো যেতে পারে। তাছাড়া মান সম্মত চিকিৎসা প্রদানকারি প্রতিটা প্রাইভেট হাসপাতালে বার্ষিক সরকারি একটা অনুদান থাকলে এমন চিকিৎসা ব্যয়ভার কিছুটা সম্ভব। এ কথা ঠিক যে প্রতিজন রোগী অসচ্ছল নয়। তাই দরকষাকষি পর্যায়ে এমন অবস্থার বিবেচনা নেয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও প্রতিটি হাসপাতালের নামে জড়িত ফাউন্ডেশন বিদেশী ও দেশের আর্থিক সচ্ছল ব্যক্তিদের অনুদান নিয়ে একটা শক্তিশালী ফান্ড গঠন করতে পারে যা অসচ্ছল রোগীদের চিকিৎসা সেবায় ব্যয় হবে।
সর্বোপরি, বাংলাদেশের বহুলাংশের উন্নয়ন ও মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে সাথে সরকারের উচিত ভবিষ্যতে চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়ন ঘটানো। কারন উন্নত চিকিৎসা সেবা লাভের আশায় অসংখ্য রোগী প্রতিবছর বিদেশের শরণাপন্ন হয় আর এতে হাজার হাজার কোটি টাকার রেভিনিয়ু হারাচ্ছে রাষ্ট্র। আগামী উন্নয়ন বাজেটে এ বিষয়ে সরকারি সম্পৃক্ততা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। কারন এ কথা সত্য যে সচ্ছল নাগরিক, রাজনীতিবিদ ও আমলারা এখন আর এদেশের চিকিৎসায় খুব একটা আস্থাশীল নয়, সামান্য রোগেই তারা বিদেশে পাড়ি জমান। সকলের জন্যে আধুনিক চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রের বিনির্মান এখন আর জৌলুসতা নয়, বরং একেবারে সময়ের দাবি। এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ খুব জরুরী।
লেখক- সাজজাদুল ইসলাম রিপন
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি (বি.আই.ইউ) এ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন।