আবহমান কাল থেকে এই বিষয়ে বিতর্ক চলে আসছে। কেউ বলছেন খুতবা আরবি ভাষা দিতেই হবে, মাতৃভাষায় খুতবা দেওয়া মাকরূহে তাহরীমী। আবার কেউ বলছেন যে মাতৃভাষাও দেওয়া জায়েজ কিংবা উত্তম। আবার কেউ কেউ বলেছেন মাতৃভাষায় খুতবা দেওয়া ওয়াজিব। আমরা উভয় পক্ষের যুক্তিগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখব যে, আসলে কোনটা সত্যের বেশি নিকটবর্তী। মহান আল্লাহর তৌফিক কামনা করছি।
যারা আরবি ভাষায় জুমার খুতবা দেওয়াকে বাধ্যতামূলক মনে করেন তাদের কাছে কোনো দলিল নাই তবে এর স্বপক্ষে কিছু যুক্তি রয়েছে। তাদের প্রথম যুক্তি হচ্ছে যে, রাসূল (সা.), সাহাবায়ে কেরাম ও প্রাচীন মুসলিমগণ সব সময়ই আরবিতে খুতবা প্রদান করেছেন এবং অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করেননি। তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বৈঠকে কখনো কখনো অনারবী ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকতো কিন্তু কোনো আয়াত থেকে জানা যায় না যে, তিনি তাদেরকে বোঝানোর জন্য আরবি ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় ভাষণ দিয়েছেন ।
প্রথম যুক্তি খণ্ডনঃ
যারা এই যুক্তি দিয়ে থাকেন তাদের এখানে একাধিক গলদ রয়েছে। প্রথমত তারা শরীয়ত সম্মত কর্মকাণ্ড এবং প্রথাসিদ্ধ ও স্বভাবসুলভ কর্মকাণ্ডের মধ্যে এবং সুন্নত ও তার উপকরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেন না। মূলত খুতবা হচ্ছে ইবাদত, ভাষা তার উপকরণ, যেমন হজ হচ্ছে ইবাদত বাহন তার উপকরণ। যদি বাহনকে ইবাদত ধরা হয় তাহলে রাসুলুল্লাহ (সা.) উঠে চড়ে হজে গিয়েছিলেন, আমাদেরকেও উঠে চড়ে হজে যাওয়া লাগবে। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কারও পক্ষেই ফরজ আদায় করা সম্ভব নয়। অনুরূপ ভাষাকে ইবাদত মনে না করে উপকরণ হিসেবে ধরলে আর কোনো সমস্যা থাকে না।
দ্বিতীয়তঃ রাসুল (সা.)-এর ভাষা আরবি ছিল। যাদের সাথে তার কথা বলার সম্পর্ক ছিল তারা সকলে হয় আরবি ছিল অথবা এমন অনারব ছিল যারা আরবি এলাকায় বসবাস করত এবং আরবি ভাষা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিল । যেমন হযরত সালমান ফারসী (রা:)। তাদের সামনে তিনি আরবী ছাড়া আর কোন ভাষায় খুতবা দিবেন? অনুরূপ সাহাবায়ে কেরামও বিভিন্ন দেশে গিয়ে যে সব লোকদের সামনে বক্তৃতা দিয়েছেন তাদের অধিকাংশ লোকই আরবী জানতো, তাই আরবি ভাষাভাষী নবী বা তাঁর অনুসারীরা আরব-অনারব জনগণের সামনে আরবিতে বক্তৃতা দিবেন, এটা তো একটা স্বভাবসুলভ কাজ । এটাকে শরীয়তের ব্যাপারে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা কিভাবে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে? তিনি যদি বলতেন যে, খুতবা আরবি ভাষায় দিতে হবে এবং অন্য কোনো ভাষায় দেওয়া যাবে না, তাহলে সেটা অবশ্যই শরীয়তের ব্যাপারে দলিল হত।
দ্বিতীয় যুক্তি হিসেবে তারা খুতবাকে সালাতের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। তারা বলেন যে, জুমার সালাত জোহরের মতো চার রাকাত ছিল । খুতবার জন্য দুই রাকাত কমিয়ে তার পরিবর্তে দুইটি খুতবা চালু করা হয়েছে। কেননা, কোনো কোনো বর্ণনা থেকে জানা যায়, হযরত উমর (রা:) সহ কিছু সাহাবী ও তাবেয়ী বলেছেন যে, খুতবার কারণে জুমার সালাত সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে ।
দ্বিতীয় যুক্তি খণ্ডনঃ
আসলে তারা সাহাবী ও তাবেয়ীদের এই কথার মর্মার্থ বুঝতে পারেননি। এখানে সলফে সালেহীন খুতবার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলেছেন যে, খুতবায় উপস্থিতি এত গুরুত্বপূর্ণ যে, এর জন্য সালাতকে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। তারা খুতবাকে সালাতের স্থলাভিষিক্ত করেননি। কয়েকটা কারণে তাদের এই যুক্তি সঠিক নয়।
১) নামাজের জন্য অজু শর্ত কিন্তু খুতবার জন্য অজু শর্ত নয়।
২) নামাজের জন্য কেবলা মুখী হওয়ার শর্ত কিন্তু খুতবার জন্য তা জরুরী তো নয় বরং কিবলার দিকে পিঠ দিয়ে মুক্তাদির দিকে মুখ করে খুতবা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
৩) নামাজের মধ্যে কথা বললে নামাজ নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু খুতবার সময় প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা জায়েজ স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)ও খুতবার মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন।
৪) দাঁড়িয়ে ইমামতি করা ফরজ কিন্তু দাড়িয়ে খুতবা দেওয়া ফরজ নয়। হেদায়া গ্রন্থকার বলেন, ولو خطب قاعدا او على غير طاهرا جاز لحصول المقصود " ইমাম সাহেব যদি বসে খুতবা দেন কিংবা অপবিত্র অবস্থায় খুতবা দেন তাহলে তা জায়েয, কেননা তাতেও উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় । (হেদায়া 1/82)
ইমাম ইবনে খুযাইমা (রহ.) বলেন، ان الخطبة ليست بالصلاه 'খুতবা সালাতের অংশ নয়'। (সহীহ ইবনে খুযাইমা, ২/২৫২)। হানাফী মাযহাবের ইমাম ও ফকীহ আল্লামা সারাখসী (রহ.) বলেন, والاصح انها لا تقوم مقام الشطر الصلاه 'সঠিক মত হল খুতবা সালাতের অংশ নয় বা দুই রাকাতের স্থলাভিষিক্তও নয়। কারণ খুতবায় কিবলামুখী হতে হয় না, কথাবার্তা বললে খুতবা নষ্ট হয় না ,ওযু ছাড়া খুতবা দিলেও তা আদায় হয়ে যায়'। (আল মাবসূত, ২/৩১৩)।
আরো পড়ুনঃ আহলে কুরআন একটা ভ্রান্ত সম্প্রদায়
তৃতীয় যুক্তি হিসেবে তারা বলেন যে, কুরআনে বলা হয়েছে, فسعوا الى ذكر الله । এখানে জিকির বলতে খুতবাকে বোঝানো হয়েছে । আর জিকির আরবি ভাষায় হতে হবে।
তৃতীয় যুক্তি খণ্ডনঃ
প্রথম নাম্বার কথা হচ্ছে জিকির আরবি ভাষায় হতে হবে এটা হানাফী মাযহাব বিরোধী ফতোয়া। কেননা,ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন, الذكر يحصل بكل لسان 'যে কোনো ভাষাতেই জিকিরের উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে'। (আল মাবসূত 1/36) । এছাড়া এই জিকির দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কারও মতে খুতবা উদ্দেশ্য, আবার কারো মতে খুতবা ও সালাত দুটি উদ্দেশ্য আবার কেউ কেউ বলেছেন যে, শুধু সালাত উদ্দেশ্য। এখানে জিকির দ্বারা উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, যারাই জিকির দ্বারা খুতবা উদ্দেশ্য নিয়েছেন তারা প্রত্যেকেই খুতবা বলতে ইমামের ওয়াজ, নসিহত ও উপদেশ বুঝিয়েছেন। আর এগুলোতো মাতৃভাষায় হওয়াই যুক্তিসঙ্গত।
সাঈদ ইবনু মুসাইয়্যিব (রহ.) বলেন, এই আয়াত দ্বারা বোঝানো হয়েছে, موعظة الامام 'অর্থাৎ ইমামের নসিহত'। (আইনী, উমদাতুল কারী , 6/162)
ইমাম ইবনে হুমাম (রহ.) বলেন, فالظاهر ان المراد بالذكر الصلاة ويجوز كون المراد به الخطبه 'এই আয়াতে জিকির অর্থ বাহ্যত সালাত তবে খুতবা অর্থও হতে পারে'। (ফাতহুল কাদীর, 2/49)
ইমাম যারকানী (রহ.) বলেন,
موعظة الامام بالخطبة أو الصلاة أو هما معا
'এই আয়াত দ্বারা খুতবার মাধ্যমে ইমামের নসিহত অথবা সালাত অথবা একসাথে দুটোই বুঝায়'। (শরহে যারকানী 1/389); তাফসীরে তাবারীতেও বলা হয়েছে, মাওইযাতুল ইমাম। (23/384)
ইমাম সরাখসী (রহ.) বলেন, والخطبة كلها وعظ وامر بمعروف 'খুতবা তো পুরাপুরি ওয়াজ ও ন্যায়ের আদেশ' । (আল মাবসূত ২/৩২৫) ।
বিভিন্ন হাদীসেও জুমার খুতবাকে ওয়াজ বলা হয়েছে। (সহীহ আবু দাউদ, ১/৯৫; মুসনাদে আহমদ, (৫/৯৯; ৪/২৬৮; হাইসামী , মাজমাউয যাওয়াইদ , ২/১৮৮)। আর ওয়াজ তো মাতৃভাষাতেই হতে হবে। وما ارسلنا من رسول الا بلسان قومه ليبين لهم
চতুর্থ যুক্তি হিসেবে তারা বলেন, বাংলা খুতবা দিলে বাংলায় নামাজও পড়তে হবে।
চতুর্থ যুক্তি খণ্ডনঃ
তাদের এই যুক্তি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা দুইটার মৌলিকত্ব ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। নামাজের নির্দিষ্ট পদ্ধতি এবং নির্দিষ্ট শব্দাবলী রয়েছে , এর বাহিরে যাবার কোনো সুযোগ নেই । তাই যে ব্যক্তি আরবি জানেন তিনি সামান্য একটু সময় ব্যয় করলেই সহজে তার অনুবাদ মুখস্ত কিংবা মর্মার্থ বুঝে নিতে পারেন। কেননা এর শব্দ বিন্যাস একেবারেই সীমিত। কিন্তু খুতবার ব্যাপারটা ঠিক এর বিপরীত। এর কোনো শাব্দিক রূপ নেই। প্রত্যেক জুম্মার একটা নতুন খুতবা দিতে হয় এবং আগ থেকে তা অনুবাদ করে বুঝে নেওয়া বা বাড়ি থেকে হৃদয়াঙ্গম করে আসা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
১) তাই সবার জন্য আরবিকে বাধ্যতামূলক করার নিশ্চিত ফল এই হবে যে, আরবি না জানা লোকদের জন্য তার নিজ একটা নিরর্থক জিনিস এবং একটা নিস্প্রান ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হবে। এতে করে খুতবা প্রবর্তনের শরীয়তে যেসব উদ্দেশ্য নিহিত ছিল শেষ হয়ে যাবে। একজন সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ বুঝতে পারে যে, তুর্কি ভাষাভাষীর সামনে জার্মানি ভাষায় বক্তৃতা করা একটা অহেতুক অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছু নয়। যে মহাবিজ্ঞানী শরীয়তের বিধান প্রণয়ন করেছেন তার সম্পর্কে কিভাবে এরূপ ধারণা করা চলে যে, ইসলামের নির্দেশনা বলে বুঝানো এবং নৈতিক শিক্ষা প্রদানের জন্য তিনি আদৌ বুঝতে পারে না এমন বক্তৃতা দেওয়ার নির্দেশ দেবেন?
২) যদি রাসুল (সা.)-এর অনুসরন করুনার্থে আরবি ভাষায় খুতবা দেওয়া জরুরি হতো তাহলে খুতবার মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.) যেসব শব্দের প্রয়োগ করেছেন সাহাবায়ে কেরাম সেই রকম শব্দ প্রয়োগ করে তাঁর পূর্ণ অনুসরণ করতেন, কিন্তু কোনো সাহাবী রাসুলুল্লাহর এই অনুসরণ করেননি বরং প্রত্যেকেই সৃজনশীল পদ্ধতিতে খুতবা দিয়েছেন।
৩) বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়, রাসূল (সা.) খুতবার মাধ্যমে বিভিন্ন উপদেশ দিতেন, নির্দেশ দিতেন, বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিতেন । আর এগুলো তো এমন ভাষায় হওয়া বাঞ্চনীয়, যে ভাষায় বললে শ্রোতা বুঝতে পারে।
৪) রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবারা খুতবা দিতেন, ওয়াজ করতেন কিন্তু আমরা তো খুতবা দেই না বরং খুতবা পড়ি। বই দেখে আবেগহীন সুরে কিছু আরবী তেলাওয়াত করি অথচ এই রকম পড়া সুন্নত নয়, সুন্নত হচ্ছে দলিলের আলোকে আবেগময় ওয়াজ করা।
৫) যদি আরবিতে খুতবা দিতেই হয় তাহলে একটি বই দেখে না বুঝে কিছু আরবী বাক্য পাঠ করার চাইতে তো কোরআন তেলাওয়াত করাই উত্তম। কেননা কুরআন তেলাওয়াত করলে র্থ না বুঝলেও অন্তত প্রতি অক্ষরের ১০-১০ করে নেকি পাওয়া যাবে।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এরমতঃ ইমামে আযম আবু হানিফার মতে মাতৃভাষায় খুতবা দেওয়া জায়েজ। তিনি বলেন, 'যে কোনো ভাষাতেই জিকিরের উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে'। (আল মাবসূত 1/36); বলাবাহুল্য যে, খুতবা একটি জিকির। তাঁর মতে সালাতে তাকবীরে তাহরীমা ফারসি ভাষায় বললে তা জায়েয হবে। আর হানাফী মাযহাবের সর্বসম্মতি ফতওয়া হচ্ছে যে, আরবি ভাষা জানেন এমন ব্যক্তিও প্রাণী জবাই করার সময় ফার্সিতে (মাতৃভাষায়) আল্লাহর নাম নিলেও তার প্রাণী হালাল হয়ে যাবে। (আল মাবসূত, ১/৩৬-৩৭)
মাতৃভাষায় তাকবীরে তাহরীমা বললে যদি তা জায়েয হয়, পশু জবাই করার সময় যদি মাতৃভাষা জিকির করা জায়েজ হয়, যে কোনো ভাষাতেই জিকির করলে যদি উদ্দেশ্য হাসিল হয় তাহলে খুতবা দেওয়ার সময় মাতৃভাষায় বক্তব্য দিলে নাযায়েজ হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বরং উদ্দেশ্যের দিকে লক্ষ রেখে মাতৃভাষাতেই খুতবা দেওয়া উত্তম।
(বি:দ্র: এটা আমার সামান্য গবেষণা । যদি শুদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে আর যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে আমার ও শয়তানের পক্ষ থেকে।)
লেখক- শায়খ আসলাম হোসাইন,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া থেকে আল-হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।