পবিত্র রমজান মাসের অর্ধদিবস যেতে না যেতেই আমাদের দেশে সবচেয়ে যে বিষয়টি নিয়ে বেশি আলোচনা করা হয় এবং সাধারণ মানুষ জানতে চায় তা হলো 'ফিতরা: টাকা নাকি খাদ্য দিয়ে দিতে হবে?' ফিতরা দেওয়া একটি ইবাদত তাই মুসলিম হিসেবে প্রত্যেককে বছরে একবার ফিতরা দিতে হয়। এ বিষয়টি আমাদের কমবেশি সবারই জানা আছে। কিন্তু সমস্যা বা মত পার্থক্য যাই বলুন না কেন ফিতরা আদায়ের ইস্যু নিয়ে আমাদের উপমহাদেশে বেশ মতপার্থক্য লক্ষণীয়। একদল আলিম বলছেন ফিতরা অবশ্যই খাদ্য দিয়ে দিতে হবে। আবার অন্য আলিমগণ বলছেন বর্তমানে ফিতরা টাকা দিয়ে দেওয়া উচিত! এখন প্রশ্ন হলো প্রকৃত অর্থে আমাদের দেশে ফিতরা: টাকা নাকি খাদ্য দিয়ে দিতে হবে?
আসুন তবে এবার এ প্রশ্নের চমৎকার একটি বিশ্লেষণ জেনে নেই। মূল্য বক্তব্য লিখেছেন তরুণ গবেষক আলিমেদ্বীন ও লেখক শায়খ আসলাম হোসাইন। 'দৈনিক লেখক' পাঠকদের জন্য আমরা তার লেখাটি এখানে হুবহু উপস্থাপন করছি, ইনশাআল্লাহ।
ফিতরা: টাকা নাকি খাদ্য দিয়ে দিতে হবে? এ প্রসঙ্গে শায়খ আসলাম হোসাইন লিখেছেন-
মাকাসিদুস শারয়্যিয়াহ সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তারা টাকা দিয়ে ফিতরা আদায়ের ব্যাপারে আপত্তি তুলে । এক ধাপ এগিয়ে এটাকে নাজায়েজ বলে। অথচ ফিতরা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য হচ্ছে গরিবদের প্রয়োজন পূরণে সহযোগিতা করা এবং তাদেরকে ঈদের আনন্দে শরিক করা। এখন কীসে তারা বেশি উপকৃত হবে এবং আনন্দ করতে পারবে এখানে তা মূখ্য বিষয়।
কেউ যদি কোনো গরিবকে ১০০০ টাকা দিয়ে কিনে এক সা খেজুর আর ৫০০ টাকার একটা নোট দিয়ে যে কোনো একটা গ্রহণ করতে বলে, দেখবেন সে ৫০০ টাকার নোটটাই নিবে। কারণ তার টাকার প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদেরকে যখন ফিতরা বাবদ খাদ্য দেওয়া হয়েছিল তখন তারা সে খাদ্য অর্ধেক মূল্যে বিক্রি করে টাকা নিয়েছে বলে অনেক রিপোর্ট অনলাইনে প্রত্যক্ষ করেছি। এটাই বাস্তবতা।
হাদিসে যেসব জিনিস দিয়ে ফিতরা দিতে বলা হয়েছে, তার একটাও আমাদের দেশের গরিবদের প্রেক্ষাপটে উপকারী নয়। তাদের কাছে টাকাই কল্যাণকর ও উপকারী। এমতাবস্থায় টাকা শুধু জায়েজ নয় বরং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টাকা দেওয়া উত্তমও হতে পারে। তবে কেউ যদি বন্যা কবলিত এলাকায় থাকে বা এমন জায়গায় থাকে যেখানে টাকার চেয়ে খাদ্য বেশি প্রয়োজন তাহলে সেখানে খাদ্য দেওয়া উত্তম।
ফিতরা: টাকা নাকি খাদ্য দিয়ে দিতে হবে? এ প্রসঙ্গে শায়খ আসলাম হোসাইন এরপর লিখেছেন-
এক দলের দাবি হচ্ছে, রাসুল (সা.)-এর যুগে তো মুদ্রা ছিল তাহলে তিনি মুদ্রা দিয়ে ফিতরা দেননি কেন?
বাহ্যত তাদের এই দাবি যুক্তি সংগত হলেও বাস্তবে মোটেও তা নয়। কেননা রাসুল (সা.)- এর যুগে দুইটা মুদ্রা ছিল- স্বর্ণমুদ্রা যাকে বলা হতো দিনার ও রৌপ্যমুদ্রা যাকে বলা হতো দিরহাম। ফিতরার জন্য যেসব জিনিস যে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে তার পরিবর্তে স্বর্ণ বা রৌপ্য দেওয়া কি সম্ভব ছিল? কখনোই নয়। এইজন্য রাসুলের যুগে পাণ্য দিয়ে পণ্য বেচাকেনার রীতি প্রচলন ছিল। মুদ্রা ছিল দুষ্কর ব্যাপার।
একটা উদাহরণ দেখুন, মনে করুন বাংলাদেশে কোনো কাগজের নোটের টাকা নেই। স্বর্ণের মুদ্রা রয়েছে। এমতাবস্থায় কেউ চাউল তিন কেজির পরিবর্তে স্বর্ণমুদ্রা দিতে চাচ্ছে। এখন চাউল তিন কেজির দাম ১৮০/ । আর স্বর্ণ মুদ্রার সর্বনিম্ন একক হচ্ছে রতি। বর্তমান বাজারে এক রতির দাম ১০০০+ টাকা। এখন বলুন, এই লোকের পক্ষে স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া সম্ভব?
এইজন্য রসুল (সা.)-এর যুগে মুদ্রা থাকা সত্ত্বেও ছোটো খাটো জিনিস বেচাকেনার ক্ষেত্রে এইগুলো ব্যবহার হতো না। পণ্যের বিনিময়ে পণ্য ব্যবহার করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে সাহাবিদের যুগেই মূল্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা শুরু হয়। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) তাঁর যুগে এক সা খেজুরের পরিবর্তে এর মূল্য বিবেচনায় অর্ধ সা গম নির্ধারণ করেন। (সহিহ বুখারি, ১৫৮)
অথচ রসুল (সা.) গমের কথা বলে যাননি। এখন খেজুরের পরিবর্তে মূল্য বিবেচনায় যদি গম গ্রহণ করা যায় তাহলে তার মূল্য হিসেবে নগদ টাকা কেনো গ্রহণ করা যাবে না?
বিখ্যাত তাবেঈ ইমাম আবু ইসহাক বলেন, ﻭﺃﺩﺭﻛﺘﻬﻢ ﻭﻫﻢ ﻳﺆﺩﻭﻥ ﺍﻟﻘﻴﻤﺔ ﻓﻲ ﺯﻛﺎﺓ ﺍﻟﻔﻄﺮ
'আমি তাঁদেরকে মূল্য দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পেয়েছি'। ( মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ)।
এখানে তাঁদের বলতে তিনি সম্মানিত সাহাবিদের বুঝিয়েছেন।
প্রসিদ্ধ তাবেঈ হাসান বসরী (রহ.) বলেন:
ﻻ ﺑﺄﺱ ﺃﻥ ﺗﻌﻄﻰ ﺍﻟﺪﺭﺍﻫﻢ ﻓﻲ ﺻﺪﻗﺔ ﺍﻟﻔﻄﺮ
'দিরহাম দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করায় কোনো অসুবিধা নেই' (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ)।
তারপর উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ.) রাষ্ট্রীয়ভাবে মুদ্রা দিয়ে ফিতরা আদায়ের নির্দেশ দেন।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম বুখারি (রহ.), ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) সহ অসংখ্য বিদ্বান মুদ্রা দিয়ে ফিতরা আদায় বৈধ ফতোওয়া দেন। কেউ কেউ মুদ্রা বেশি উপকারী হলে এটা দিয়ে ফিতরা আদায় করা উত্তমও বলেছেন। কেননা, এটা সম্পূর্ণ আপেক্ষিক বিষয়। স্থান-কাল, পাত্র ভেদে মানুষের কল্যাণের দিক বিবেচনা করে ফিতরা দেওয়ার পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। আর 'মাকাসিদুস শারয়্যিয়াহ'-এর দাবিও এটাই।
লেখক- শায়খ আসলাম হোসাইন,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া থেকে আল-হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।
জাযাকাল্লাহ খাইরান
উত্তরমুছুন