তারাবির সালাত নিয়ে আমাদের দেশে বাড়াবাড়ি করা একটি আলোচিত বিষয় যা বহুকাল ধরেই চলমান রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক যুগে এই আলোচনা আরো বহুগুণে বেগ পেয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে। কেননা আজকাল যে কেউ ইচ্ছেমত যে কোনো বিষয় নিয়েই ফেসবুক ও ইউটিউবে লেখালেখি বা কন্টেন্ট তৈরি করে ফেলছেন। আর একদল অন্যদলকে কট্টর ভাষায় সমালোচনা করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। সোশ্যাল মিডিয়ার এমন উন্মুক্ত দৌরাত্ম্যে তারাবির সালাত নিয়ে আহলে হাদিস ও হানাফি মতাদর্শের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আলিমরাও আজ কট্টরপন্থী হয়ে বিতর্কে লিপ্ত। তাই এসকল সমালোচনা ও বিতর্কের মাঝে একটি সাম্যতা বজায় রেখে 'আহলে হাদিস ও হানাফি আলেমদের দৃষ্টিতে তারাবির সালাত' শিরোনামে অল্প কথায় চমৎকার একটি বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন একসময়ে অন্যতম জনপ্রিয় একজন মধ্যমপন্থী ইসলামী লেখক ও আলিম শায়খ আসলাম হোসাইন।
শায়খ আসলাম হোসাইনের ফেসবুকে প্রোফাইল থেকে সংগৃহীত 'আহলে হাদিস ও হানাফি আলেমদের দৃষ্টিতে তারাবির সালাত' শিরোনামে লেখা চমৎকার সেই বিশ্লেষণটি আমরা 'দৈনিক লেখক' পাঠকদের উদ্দেশ্য এখানে হুবহু তুলে ধরছি, ইনশাআল্লাহ।
শায়খ আসলাম হোসাইন লিখেছেন-
'আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী (রহ.) একজন হানাফি বিদ্বান ও দেওবন্দি আলেম। আমাদের কানাইঘাটের ক্ষণজন্মা আলেমদের মধ্যে তিনি একজন। সেই বায়মপুরী হুজুর 'সত্যের আলো' বইতে তারাবিহ সংক্রান্ত দীর্ঘ আলোচনা করেন। সেখানে তিনি যা বলেছেন তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে:
১. রসুল সা. তারাবির নামাজ আট রাকাত পড়েছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
২. হজরত উমর (রা.) আট রাকাত চালু করেছিলেন, বিশ রাকাত নয়। তিনি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন হজরত উমর থেকে ২০ রাকাত সংক্রান্ত হাদিসগুলো গ্রহণযোগ্য মানে উত্তীর্ণ নয়। কিন্তু অন্যান্য বিদ্বানদের ব্যাখ্যায় তার এ বক্তব্য টিকে না। হজরত উমর যেভাবে ৮ রাকাত চালু করেছিলেন, ঠিক তদ্রূপ পরবর্তীতে ২০ রাকাতও চালু করেছিলেন, এটা সুপ্রতিষ্ঠিতভাবে প্রমাণিত।
৩. তিনি বলেছেন, তারাবিহ এবং তাহাজ্জুদ একই নামাজ। কোনো পার্থক্য নেই।
৪. দীর্ঘ সময় নিয়ে অর্ধরাত পর্যন্ত তারাবিহ পড়তে পারলে আট রাকাতই উত্তম। এটা হুবহু সুন্নতের অনুসরণ।
আমাদের অনলাইন মুফতিরা আট রাকাতের অস্তিত্ব নাই বলে আহলে হাদিসকে ফেতনাবাজ বলে তুলোধুনো করে ফেলেন। মুখ দিয়ে যাচেচ্ছা তাই বলেন কিন্তু বায়মপুরী হুজুরকে কখনো ফেতনাবাজ বলছে? তাঁর সমালোচনা করছে? জীবনেও না। কারণ তিনি আমাদের আকাবীর।'
'আহলে হাদিস ও হানাফি আলেমদের দৃষ্টিতে তারাবির সালাত' শিরোনামে তিনি এরপর লিখেন-
'আহলে হাদিসের কাছে যদি আমরা যাই তাহলে দেখতে পাই তাদের অবস্থা এদের থেকে একটুও উন্নত নয়। তাদের বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন কোনো অংশে কম নয়।
হানাফি মুফতিরা বিভিন্নভাবে হজরত উমর রা. কর্তৃক আট রাকাত পড়া সংক্রান্ত হাদিসকে অগ্রহণযোগ্য প্রমাণ করেই ছাড়বে। এমনকি আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরিসহ হানাফি অনেক আলেম রসুল (সা.)-এর তারাবির সালাত আট রাকাত ছিল বলে মত ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু তারা তাদের এই সব উক্তিকে বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে অস্বীকার করবে । শুধু পারে না বায়ামপুরী হুজুরের কথাগুলো। কেননা দুর্ভাগ্যবশত বইটা বাংলায় লেখা। তাই চাইলেও সম্ভব হয় না।
আহলে হাদিসগণ ঠিক তদ্রুপভাবে হজরত উমর রা. থেকে বিশ রাকাত সম্বলিত হাদিসকে ইনিয়ে বিনিয়ে বাতিল করার চেষ্টা করবে। অথচ তারা যাদেরকে নিজের মাযহাবের ইমাম মনে করে সেই ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.), শাইখ বিন বায (রহ.) ও শাইখ উসাইমিন (রহ.) এর মতে উমর (রা.) থেকে বিশ রাকাত তারাবিহ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। এ নিয়ে তারা হানাফিদের বিরুদ্ধে খুব সোচ্চার। খুবই বিশ্রী ভাষায় সমালোচনা করে কিন্তু নিজেদের ইমামদের ব্যাপারে একদম চুপ।
রিজাল্ট কী দাঁড়াল?
আসলে আমাদের কারোই সত্য খোঁজা এবং সত্য প্রকাশ করা উদ্দেশ্য নয়। নিজের মত প্রতিষ্ঠা এবং বিপরীত মতের লোককে ঘায়েল করাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। অতএব , এসব ঝগড়াটে মুফতিদের এড়িয়ে চলাই আমাদের দায়িত্ব।'
'আহলে হাদিস ও হানাফি আলেমদের দৃষ্টিতে তারাবির সালাত' নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে লেখক আসলাম হোসাইন হতে প্রকাশিত 'প্রচলিত মানহাজ' বইয়ের (তারাবির নামাজের রাকআত) অধ্যায়টি আরও বিস্তারিত ও ব্যাপক তথ্যবহুল একটি বিশ্লেষণ। 'দৈনিক লেখক' পাঠকবৃন্দকে মধ্যমপন্থী এই বইটি পড়ার বিনীত অনুরোধ রইল। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
লেখক- আসলাম হোসাইন,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া থেকে আল-হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।